সঙ্ক্রামক রোগ মহামারী তথা জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ হিসেবে আমরা গভীর দুশ্চিন্তার মধ্যে রয়েছি। দুশ্চিন্তা এই জন্য যে কোভিড ১৯ প্রতিরোধের চালুপদ্ধতিগুলো মানুষের শারীরিক-মানসিক স্বাস্থ্যের পক্ষে বিশেষ ক্ষতিকর। তাই আমাদের প্রস্তাবনা – বিশেষ গোষ্ঠী-কেন্দ্রিক সুরক্ষা।
আমাদের মধ্যে কেউ দক্ষিণপন্থী, কেউ বাম – আমরা ছড়িয়ে আছি পৃথিবী জুড়ে – আমাদের কর্মজীবন ব্যাপৃত থেকেছে মানুষের সুরক্ষার কাজে।যে লক-ডাউন নীতি আজো কার্যকরী রয়েছে জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে তার আশু এবং দীরঘমেয়াদি ফলাফল মারাত্মক। এর ফলে শিশুদের ভাক্সিনদেওয়ার প্রক্রিয়া শ্লথ হয়েছে, হৃদরোগ চিকিৎসার ফলাফলে নেতিবাচক ছাপ পড়েছে, ক্যান্সার নির্ণয় কমে গেছে, মানসিক সাস্থ্য-সমস্যার হয়েছেবাড়বৃদ্ধি – আগামী বছরগুলিতে অনেকবেশী বাড়তি মৃত্যুর সম্ভাবনা সামনে আসছে। আর তার সিংহভাগ শিকার হবেন শ্রমিকশ্রেণী এবংতুলনামূলকবাবে নতুন প্রজন্ম। ছাত্রছাত্রীদের বিদ্যায়তন থেকে দূরে রাখার মত গভীর অবিচার কে আর
যতদিন ভ্যাক্সিন না পাওয়া যাচ্ছে ততদিন এইসব প্রকরণ গুলোকে বলবৎ রাখা সমাজে অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হবে, বিপুল বৃহদংশে তারশিকার হবেন সমাজের দুর্বল – আপেক্ষিকভাবে পিছিয়ে পড় মানুষেরাই।
সুখের কথা যে এই ভাইরাসটি সম্পর্কে আমাদের জানাবোঝা বাড়ছে। একথা আমরা জানি যে বয়স্ক এবং নানাভাবে অক্ষম মানুষদের মধ্যেকোভিড ১৯ জনিত মৃত্যুর সম্ভাবনা তরুণদের তুলনায় হাজারগুনে বেশী। জোর দিয়েই আজ বলা যাচ্ছে কোভিড ১৯ শিশুদের ক্ষেত্রে ইনফ্লুয়েঞ্জাসহ অন্যান্য অনেক অসুখের তুলনাতেই অনেক কম বিপজ্জনক।
জনসমাজে যখন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়তে থাকে তখন সকলের মধ্যেই, এমনকি যাদের বিপদাশঙ্কা বেশী তাদের ক্ষেত্রেও সংক্রমনেরসম্ভাবনা কমে যায়। আমাদের জানা আছে যে সময়ের সাথে সমস্ত জনসমুদয়ের মধ্যেই কিন্তু হার্ড ইমিউনিটি গড়ে উঠবে।হার্ড ইমিউনিটি এমনএকটা অবস্থান বিন্দু সঙ্ক্রমনের হার স্থিতিশীল হয়ে আসে। এই বিন্দুটিতে পৌছনোর ক্ষেত্রে ভ্যাক্সিন সহায়ক ভূমিকা নিতেই পারে, যদিওব্যাপারটি ভাক্সিন নির্ভর নয়। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত মৃত্যুহার এবং সামাজিক ক্ষতি, উভয়ের মাত্রাকেই যথাসম্ভব কমের মধ্যে রেখে হার্ডইমিউনিটি পথে এগোনো।
হার্ড ইমিউনিটির পথে হাঁটার সবচেয়ে সংবেদনশীল দৃষ্টিভঙ্গী সেতাই, যা কিনা বিপদ এবং সুযোগের মধ্যে একটা সাযুজ্য রাখতে পারে। যাদেরমধ্যে মৃত্যু সম্ভাবনা সবচেয়ে কম তাদের মধ্যে প্রাকৃতিকভাবে সংক্রমনের মধ্যে দিয়ে হার্ড ইমিউনিটির পথ সুগম করতে হবে – সেটা তাদেরস্বাভাবিক জীবন সছল রেখেই করা যেতে পারে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে এই প্রক্রিয়ায় যাদের বিপদাশঙ্কা বেশী তাদের জন্যে উন্নততর সুরক্ষারব্যবস্থাও করতে হবে। আমরা এটাকেই বলছি বিশেষ গোষ্ঠী-কেন্দ্রিক সুরক্ষা।
যাদের বিপদাশঙ্কা বেশী তাদের জন্যে উন্নততর সুরক্ষার ব্যবস্থা নেওয়া – কোভিড ১৯ সংক্রান্ত জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থায় এটাই হওয়া উচিত ভরকেন্দ্র।উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, নারসিং হোমগুলি এমন সব কর্মীদের ব্যবহার করুক, যাদের ইতিমধ্যেই প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠেছে।তাছাড়াদরকার অন্য কর্মী এবং ভিজিটরদের বারবার করে আর টি পি সি আর পরীক্ষা করান। কর্মীদের রোটেশন যথাসম্ভব কমিয়া আনা। তাছাড়াঅবসরকালীন মানুষজনদের জন্য বাড়ীতে মুদিখানার জিনিষপত্র এবং অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্য পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা। তাদের যদিআত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতেই হয়, তাহলে যতদূর সম্ভব, সেটা বাড়ীর বাইরেই ব্যবস্থা করা ভাল। কি কি করা উচিত আর কি নয়, তারএকটা ব্যাপক-বিস্তৃত তালিকা তথা ব্যবস্থাপনা, যার মধ্যে যেসব গৃহস্থালিতে একাধিক প্রজন্মের মানুষ বসবাস করেন তাদের জন্যেও ব্যবস্থাথাকবে, সেটা তো তৈরি করা যেতেই পারে। সেটাই তো জনস্বাস্থ্যব্যবস্থা তথা জনস্বাস্থ-কর্মী দের বিবেচ্য বিষয়।
যাদের বিপদাশঙ্কা কম তাদের অবিলম্বে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে দেওয়া উচিত। পরিচ্ছন্নতার খুব সাধারণ প্রকরণ, যেমন হাত ধোয়া, অসুস্থহলে বাড়ীতে থাকা – হার্ড ইমিউনিটির ক্ষয়ক্ষতি সীমাটিকে নিম্নমুখী রাখতে হলে সকলকেই এগুলি পালন করতে হবে। মুখোমুখি শিক্ষাদানব্যবস্থার জন্য স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয় গুলি খুলে দেওয়া দরকার। খেলাধুলা এবং অন্যান্য সৃজন-মুখী কাজের ক্ষেত্রগুলি আবার শুরু হোক। যাদেরবিপদাশঙ্কা কম, সেই তরুন প্রজন্মের লোকজন বাড়ীতে না থেকে কাজে ফিরুক। রেস্তোরা এবং ব্যবসায়িক কাজকর্ম আবার চালু হোক।চালুহোক শিল্পকর্ম, সঙ্গীত, খেলাধুলা এবং অন্যান্য সৃজন-মুখী কর্মকাণ্ড। এভাবেই তৈরি হোক হার্ড ইমিউনিটি, যা প্রকৃতই গোটা সমাজকে সুরক্ষাদেবে।
Dr. Jay Bhattacharya, professor at Stanford University Medical School, a physician, epidemiologist, health economist, and public health policy expert focusing on infectious diseases and vulnerable populations.